সুদূর দিনাজপুরের উত্তরে, সীমান্তঘেঁষা এক গহীন অরণ্য—লোকমুখে পরিচিত “কালোপাহাড় বন” নামে। এই বনের মাঝখানে একটি পুরনো, ধ্বংসপ্রায় বাংলো—যার ইতিহাস বহু পুরনো, আর গুজব আরও ভয়াবহ। কেউ বলে, সেখানে এক ব্রিটিশ আর্মি অফিসার আত্মহত্যা করেছিল। কেউ বলে, বাংলোটার আশেপাশে রাতে কুকুরও হাঁটে না।
তবে এইসব গুজবে কান না দিয়ে ঢাকার তরুণ ইতিহাসবিদ সাইমন ঠিক করেন, তিনি যাবেন। গবেষণার জন্য নয়, বরং নিজের মধ্যকার ভয়কে জয় করার জন্য। সঙ্গে ছিলেন তার বন্ধু নাদিম ও রিমা—দুজনেই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়।
তারা রাত ৮টার সময় পৌঁছাল সেই বাংলোয়। চারদিকে কুয়াশা জমে উঠছে, গাছগুলো দাঁড়িয়ে যেন পাহারাদার। বাংলোর ভেতরে ঢুকতেই একটা অদ্ভুত গন্ধ—সাদা দেওয়ালে কালচে ছোপ, বাতাসে ধুলো আর মৃত পাখির পালক উড়ে বেড়াচ্ছে।
তাদের ক্যামেরা, নোটবুক আর টর্চ লাইট বের করে কাজ শুরু হলো। সাইমন একটা ঘরের কোণে দেখতে পেল পুরনো একটা আয়না, ধূলো মুছে দেখা গেল তার ফ্রেমে ইংরেজিতে লেখা: *”He who sees too deep, sees death.”*
রিমা বলল, “ভৌতিক সিনেমার মতো লাগছে রে।”
নাদিম হাসতে হাসতে বলল, “চল আয়নায় একবার ছবি তুলি!”
তবে ক্যামেরায় আয়নার প্রতিফলনে যা ধরা পড়ল, তাতে মুহূর্তেই হাওয়া পাল্টে গেল। আয়নায় তিনজনের পাশাপাশি দেখা যাচ্ছিল চতুর্থ এক অবয়ব—লম্বা, কোট পরা, আর মুখটা যেন… বিকৃত।
“এটা কী?!”, রিমা আতঙ্কিত। সাইমন দ্রুত আয়নার দিকে তাকায়—কিছু নেই। আবার ক্যামেরায় দেখে—ছবিতে সে লোকটা এখনও রয়ে গেছে।
তারপর শুরু হয় অদ্ভুত সব ঘটনা। জানালা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। ঘড়ি থেমে যায় ঠিক ৯টা ১৩ মিনিটে। টর্চ লাইটের আলো হঠাৎ নিভে যায়। আর বাংলোর ভেতর থেকে শোনা যায় ফিসফিস শব্দ—”ফিরে যাও… এটা তোমাদের জায়গা না…”
তারা দৌড়ে বের হতে চায়, কিন্তু দরজাটা লকড। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে—সেই কোট পরা লোকটা দাঁড়িয়ে আছে বনের ভেতরে। তার চোখ দুটো জ্বলছে লাল আলোয়।
রিমা তখন কাঁপতে কাঁপতে বলে, “আমি এই বাংলোর ইতিহাস পড়েছিলাম। ১৯৩7 সালে ব্রিটিশ এক মেজর এখানে এক উপজাতি মেয়েকে মেরে ফেলে। সেই মেয়ে ছিল ওই অরণ্যের রক্ষক। আর এই বাংলোটা তখন থেকেই অভিশপ্ত।”
সাইমন তৎক্ষণাৎ ব্যাগ থেকে বের করে একটি লোহার তাবিজ, যেটা সে সঙ্গে এনেছিল। লোককথা অনুযায়ী, এটি ওই রক্ষিণীর আত্মাকে শান্ত করতে পারে। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “আমরা অপরাধী নই। আমরা শুধু জানতে এসেছি। তুমি চাইলে আমরা চলে যাবো।”
এক মুহূর্তের জন্য বাংলোর কাঁপুনি থেমে যায়। দরজা আপনা আপনি খুলে যায়। তারা ছুটে বের হয়ে আসে।
পরদিন তারা গ্রামে ফিরে সব ঘটনা বললেও কেউ বিশ্বাস করেনি। তবে এক বৃদ্ধ বলেছিলেন, “তোমরা বেঁচে গেছো, কারণ আত্মা বুঝেছে—তোমাদের মনে ভক্তি ছিল। ভয় নয়, সম্মানই তাকে শান্ত করে।”
এরপর থেকে ওই বাংলোতে আর কেউ যায় না। তবে মাঝেমধ্যে কেউ কেউ দেখে, রাতে সেই আয়নার কাচে একজন দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে… যেন অপেক্ষা করছে আবার কেউ আসবে।
শেষ।