“নীল ছাদের নিচে”

রাত তখন ২টা ৪৫ মিনিট। ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল অনির্বাণ। তার চোখ আকাশে, কিন্তু মন আটকে আছে ছাদের কোণে রাখা পুরনো কাঠের বাক্সটার দিকে। গত তিনদিন ধরে সে বাক্সটার ভেতর থেকে আসা ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনতে পাচ্ছিল, যদিও বাক্সটা একেবারেই বন্ধ, আর তার ভেতরে কোনো ঘড়ি থাকার কথা নয়।

এই বাড়িটা সে মাত্র এক সপ্তাহ আগে ভাড়া নিয়েছে। পুরনো, দুইতলা, শহরের প্রান্তে। বাড়ির মালিক বিদেশে, চাবি রেখে গেছে এক দালালের কাছে। তখনো বুঝতে পারেনি, নীল ছাদের নিচে এমন কিছু লুকিয়ে আছে যা তার জীবনটাই বদলে দেবে।

প্রথম রাতে কিছু অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি। দ্বিতীয় রাতে ঘুম ভেঙে যায় জানালার শব্দে। তৃতীয় রাতে সে স্বপ্ন দেখে – ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ, চোখে গাঢ় নীল ছায়া, বলছে, “ঘড়ির কাঁটা থেমে গেলে আমি ফিরে আসবো।”

চতুর্থ রাতে সে উঠে যায় ছাদে। ওই বাক্সটা তখনো ঠিক একই জায়গায়। কৌতূহল দমন করতে না পেরে, সে বাক্সটা টেনে আনে। ভারী কাঠ, তালাবন্ধ। কিন্তু তালাটা এক ধাক্কাতেই খুলে যায়।

ভেতরে ছিল একটা পুড়ে যাওয়া নোটবুক, একটা পকেট ঘড়ি, আর একটা রক্তমাখা কাপড়। ঘড়িটা তখন ঠিক ২টা ১৩ মিনিট দেখাচ্ছে, আর কাঁটা নড়ছে না।

নোটবুক খুলতেই প্রথম পাতায় লেখা—
“যদি কেউ এই ঘড়ি আবার চালু করে, সময় উল্টো দিকে হাঁটবে। সাবধান।”

অনির্বাণ হাসে। ভূতের গল্প বলে মনে হয় তার। সে ঘড়ির পেছনে থাকা ছোট্ট কাঁটা ঘুরিয়ে চালু করে দেয়। ঘড়ির কাঁটা চলতে শুরু করে, কিন্তু সেই মুহূর্তেই চারপাশটা যেন কেঁপে ওঠে।

আশপাশের বাতাস ভারি হয়ে যায়। নিচে নেমে দেখে, দেয়ালের রং পাল্টে গেছে, ঘড়ির কাঁটা ১টা ৫৭ দেখাচ্ছে, অথচ সে ২টা ১৩-তে ঘড়ি চালু করেছিল।

সে জানে না কীভাবে, কিন্তু সময় যেন পিছিয়ে যাচ্ছে।

পরদিন সকালে পেপার পায় না। মোবাইল নেইটওয়ার্কহীন। রাস্তায় বেরিয়ে দেখে পাশের দোকানগুলো বন্ধ, মানুষের পোশাকে পুরনো ঢঙ। এক বৃদ্ধ বলে, “আজ তো ২০০২ সালের ১৫ জুলাই!”

সে প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু বাড়ির ড্রয়ারে পাওয়া বিদ্যুৎ বিলটা দেখে চমকে ওঠে। তারিখ সত্যিই ২০০২।

পরপর তিনদিন সময় পেছাতে থাকে। প্রতিবার সে ঘড়ির কাঁটা চালু করলেই, দিন পেছায়। অবশেষে সে ১৯৮৭ সালে এসে পড়ে। এখন সে নিশ্চিত—ঘড়িটা সময় ঘুরিয়ে দেয়।

কিন্তু প্রতিবার সময় পেছালে, তার শরীর দুর্বল হতে থাকে। মাথাব্যথা, চোখের নিচে কালি, আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার—তার ছায়া প্রতিদিন একটু করে ছোট হয়ে যাচ্ছে।

একসময় ছায়া একেবারেই মিলিয়ে যায়।

সে বুঝে, তার অস্তিত্ব মুছে যেতে বসেছে।

সে সিদ্ধান্ত নেয় সময় আবার সামনে এগিয়ে নেবে। ঘড়িটাকে উল্টো ঘুরিয়ে দেয়, কিন্তু এবার ঘড়ি বন্ধ। কোনোভাবেই চালু হয় না।

সেই রাতেই আবার দেখা দেয় সেই স্বপ্নের বৃদ্ধ। এবার মুখ একেবারে কালো, চোখহীন। বলে,
“তুই আমার ঘড়ি ছুঁয়েছিস। এবার তোকে সময়ের জাদুকরে পরিণত হতে হবে।”

অনির্বাণ জোরে না বলে ওঠে—“আমি ফিরে যেতে চাই। এখনকার সময়েই ভালো ছিল!”

বৃদ্ধ বলে, “তাহলে একটাই উপায়—কারও আরেকজনকে এই ঘড়ি স্পর্শ করাতে হবে। যাতে সে সময় হারিয়ে ফেলে, তুই মুক্তি পাবি।”

পরদিন সকালে বাড়িওয়ালার দালাল বাড়িতে আসে ভাড়া চাইতে। অনির্বাণ হেসে বলে, “ছাদে একটা জিনিস দেখাবো, উঠবেন?”

দালাল উঠে আসে। অনির্বাণ তাকে বাক্স দেখায়, ঘড়িটা দেয় তার হাতে। দালাল অবাক, ঘড়ি চালু করে।

অবিকল আগের মতো, চারপাশ কেঁপে ওঠে। দালালের চিৎকার শুনে অনির্বাণ নিচে নেমে আসে।

ঘড়ি আবার চলছে, অনির্বাণ আয়নায় দেখে তার ছায়া ফিরে এসেছে। কিন্তু এবার আয়নায় দালালের ছায়া নেই।

তিন দিন পর বাড়ির মালিক ফোন করে জানায়—দালাল নিখোঁজ। পুলিশ কিছু খুঁজে পায় না। অনির্বাণ তখন শুধু বলে,
“আমিও তো প্রায় হারিয়েই গিয়েছিলাম…”

সে সিদ্ধান্ত নেয়, বাক্সটা আবার ছাদের কোণে রাখবে, চুপচাপ।

তবে মাঝে মাঝে, গভীর রাতে, ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে ওঠে। আর অনির্বাণ জানে—কারও না কারও সময়, আবার উল্টো দিকে হাঁটছে…